দুই বোন পর্ব-৩। উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর - omar360. বাংলাদেশের সকল শিক্ষণীয় বিষয় এর সমাহার

Header Ads

দুই বোন পর্ব-৩। উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

দুই বোন পর্ব-৩

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শশাঙ্ক বলে, “তোমার সময় নষ্ট করতে গেলে আমারও সময় নষ্ট। অতএব শোধবোধ।”

তার পরে খানিকক্ষণ কাড়াকাড়ির চেষ্টা করে অবশেষে ঊর্মি হার মানে। সেটা যে ওর পক্ষে নিতান্ত আপত্তিজনক তা মনে হয় না। এইরকম বাধা পেলেও কর্তব্যবুদ্ধির পীড়ন দিন পাঁচ-ছয় একাদিক্রমে চলে, তার পরে আবার তার জোর কমে যায়। বলে, “শশাঙ্কদা, আমাকে দুর্বল মনে কোরো না। মনের মধ্যে প্রতিজ্ঞা দৃঢ় করেই রেখেছি।”

“অর্থাৎ?”

“অর্থাৎ, এখানে ডিগ্রি নিয়ে য়ুরোপে যাব ডাক্তারি শিখতে।”

“তার পরে?”

“তার পরে হাঁসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে তার ভার নেব।”

“আর কার ভার নেবে। ঐ-যে নীরদ মুখুজ্জে বলে একটা ইনসাফারেব্‌ল্‌--”

শশাঙ্কের মুখ চাপা দিয়ে ঊর্মি বলে, “চুপ করো। এই-সব কথা বল যদি তোমার সঙ্গে একেবারে ঝগড়া হয়ে যাবে।”

নিজেকে ঊর্মি খুব কঠিন করে বলে, ‘সত্য হতে হবে আমাকে, সত্য হতে হবে।’ নীরদের সঙ্গে ওর যে সম্বন্ধ বাবা স্বয়ং স্থির করে দিয়েছেন তার প্রতি খাঁটি না হতে পারাকে ও অসতীত্ব বলে মনে করে।

কিন্তু মুশকিল এই যে, অপর পক্ষ থেকে কোনো জোর পায় না। ঊর্মি যেন এমন একটি গাছ যা মাটিকে আঁকড়ে আছে, কিন্তু আকাশের আলো থেকে বঞ্চিত, পাতাগুলো পাণ্ডুবর্ণ হয়ে আসে। এক-এক সময় অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে; মনে মনে ভাবে, এ মানুষটা চিঠির মতো চিঠি লিখতে পারে না কেন।

ঊর্মি অনেক কাল কন্‌ভেণ্টে পড়েছে। আর-কিছু না হোক ইংরেজিতে ওর বিদ্যে পাকা। সে কথা নীরদের জানা ছিল। সেইজন্যেই, ইংরেজি লিখে নীরদ ওকে অভিভূত করবে এই ছিল তার পণ। বাংলায় চিঠি লিখলে বিপদ বাঁচত, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বেচারা জানে না যে সে ইংরেজি জানে না। ভারী ভারী শব্দ জুটিয়ে এনে, পুঁথিগত দীর্ঘপ্রস্থ বচন যোজনা ক’রে, ওর বাক্যগুলোকে করে তুলত বস্তা-বোঝাই গোরুর গাড়ির মতো। ঊর্মির হাসি আসত, কিন্তু হাসতে সে লজ্জা পেত; নিজেকে তিরস্কার করে বলত, বাঙালির ইংরেজিতে ত্রুটি হলে তা নিয়ে দোষ ধরা স্নবিশ।

দেশে থাকতে মোকাবিলায় যখন নীরদ ক্ষণে ক্ষণে সদুপদেশ দিয়েছে তখন ওর রকম-সকমে সেগুলো গভীর হয়ে উঠেছে গৌরবে। যতটা কানে শোনা যেত তার চেয়ে আন্দাজে তার ওজন হত বেশি। কিন্তু লম্বা চিঠিতে আন্দাজের জায়গা থাকে না। কোমর-বাঁধা ভারী ভারী কথা হালকা হয়ে যায়, মোটা মোটা আওয়াজেই ধরা পড়ে বলবার বিষয়ের কম্‌তি।

নীরদের যে ভাবটা কাছে থাকতে ও সয়ে গিয়েছিল সেইটে দূরের থেকে ওকে সব চেয়ে বাজে। লোকটা একেবারেই হাসতে জানে না। চিঠিতে সব চেয়ে প্রকাশ পায় সেই অভাবটা। এই নিয়ে শশাঙ্কের সঙ্গে তুলনা ওর মনে আপনিই এসে পড়ে।

তুলনার একটা উপলক্ষ এই সেদিন হঠাৎ ঘটেছে। কাপড় খুঁজতে গিয়ে বাক্সের তলা থেকে বেরোল পশমের বোনা একপাটি অসমাপ্ত জুতো। মনে পড়ে গেল চার বছর আগেকার কথা। তখন হেমন্ত ছিল বেঁচে। ওরা সকলে মিলে গিয়েছিল দার্জিলিঙে। আমোদের অন্ত ছিল না। হেমন্তে আর শশাঙ্কে মিলে ঠাট্টাতামাশার পাগলা -ঝোরা বইয়ে দিয়েছিল। ঊর্মি তার এক মাসির কাছ থেকে পশমের কাজ নতুন শিখেছে। জন্মদিনে দাদাকে দেবে বলে একজোড়া জুতো বুনছিল। তা নিয়ে শশাঙ্ক ওকে কেবলই ঠাট্টা করত; বলত “দাদাকে আর যাই দাও, জুতো নয়। ভগবান মনু বলেছেন ওতে গুরুজনের অসম্মান হয়।”

ঊর্মি কটাক্ষ করে বলেছিল, “ভগবান মনু তবে কাকে প্রয়োগ করতে বলেন।”

শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে বললে, “অসম্মানের সনাতন অধিকার ভগ্নীপতির। আমার পাওনা আছে। সেটা সুদে ভারী হয়ে উঠল।”

“মনে তো পড়ছে না।”

“পড়বার কথা নয়, তখন ছিলে নিতান্ত নাবালিকা। সেই কারণেই তোমার দিদির সঙ্গে শুভলগ্নে যেদিন এই সৌভাগ্যবানের বিবাহ হয়, সেদিন বাসররজনীর কর্ণধারপদ গ্রহণ করতে পার নি। আর সেই কোমল করপল্লবের অরচিত কান-মলাটাই রূপ গ্রহণ করছে সেই করপল্লবরচিত জুতোযুগল। ওটার প্রতি আমার দাবি রইল জানিয়ে রেখে দিলুম।”

দাবি শোধ হয় নি, সে জুতো যথাসময়ে প্রণামীরূপে নিবেদিত হয়েছিল দাদার চরণে। তার পর কিছুকাল পরে শশাঙ্কর কাছ থেকে ঊর্মি একখানি চিঠি পেল। পেয়ে খুব হেসেছে সে। সেই চিঠি আজও তার বাক্সে আছে; আজ খুলে সে আবার পড়লে-

কাল তো তুমি চলে গেলে। তোমার স্মৃতি পুরাতন হতে না হতে তোমার নামে একটা কলঙ্ক রটনা হয়েছে, সেটা তোমার কাছে গোপন করা অকর্তব্য মনে করি।

আমার পায়ে একজোড়া তালতলীয় চটি অনেকেই লক্ষ করেছে। কিন্তু তার চেয়ে লক্ষ করেছে তার ছিদ্র ভেদ করে আমার চরণনখরপঙ্‌ক্তি মেঘমুক্ত চন্দ্রমালার মতো। (ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল দ্রষ্টব্য। উপমার যাথার্থ্য সম্বন্ধে সন্দেহ ঘটলে তোমার দিদির কাছে মীমাংসনীয়।) আজ সকালে আমার আপিসের বৃন্দাবন নন্দী যখন আমার সপাদুক চরণ স্পর্শ করে প্রণাম করলে তখন আমার পদমর্যাদায় যে বিদীর্ণতা প্রকাশ পেয়েছে তারই অগৌরব মনে আন্দোলিত হল। সেবককে জিজ্ঞাসা করলেম, ‘মহেশ, আমার সেই অন্য নূতন চটিজোড়াটা গতিলাভ করেছে অন্য কোন্‌ অনধিকারীর শ্রীচরণে।’ সে মাথা চুলকিয়ে বললে, ‘ও বাড়ির ঊর্মিমাসিদের সঙ্গে আপনিও যখন দার্জিলিঙ যান সেই সময়ে চটিজোড়াটাও গিয়েছিল। আপনি ফিরে এসেছেন সেইসঙ্গে ফিরে এসেছে তার একপাটি, আর-এক পাটি--‘ তার মুখ লাল হয়ে উঠল। আমি এক ধমক দিয়ে বললুম, ‘ব্যস, চুপ।’ সেখানে অনেক লোক ছিল। চটিজুতো-হরণ হীনকার্য। কিন্তু মানুষের মন দুর্বল, লোভ দুর্দম, এমন কাজ করে ফেলে, ঈশ্বর বোধ করি ক্ষমা করেন। তবু অপহরণ-কাজে বুদ্ধির পরিচয় থাকলে দুষ্কার্যের গ্লানি অনেকটা কাটে। কিন্তু একপাটি চটি!!! ধিক্‌!!!

যে এ কাজ করেছে, যথাসাধ্য তার নাম আমি উহ্য রেখেছি। সে যদি তার স্বভাবসিদ্ধ মুখরতার সঙ্গে এই নিয়ে অনর্থক চেঁচামেচি করে তা হলে কথাটা ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে যাবে। চটি নিয়ে চটাচটি সেইখানেই খাটে যেখানে মন খাঁটি। মহেশের মতো নিন্দুকের মুখ বন্ধ এখনই করতে পার একজোড়া শিল্পকার্যখচিত চটির সাহায্যে। যেমন তার আস্পর্ধা!

পায়ের মাপ এইসঙ্গে পাঠাচ্ছি।

চিঠিখানি পেয়ে ঊর্মি স্মিতমুখে পশমের জুতো বুনতে বসেছিল, কিন্তু শেষ করে নি। পশমের কাজে আর তার উৎসাহ ছিল না। আজ এটা আবিষ্কার করে স্থির করলে এই অসমাপ্ত জুতোটাই দেবে শশাঙ্ককে সেই দার্জিলিঙ যাত্রার সাম্বৎসরিক দিনে। সেদিন আর কয়েক সপ্তাহ পরেই আসছে। গভীর একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল-হায় রে, কোথায় সেই হাস্যোজ্জ্বল আকাশে হালকা পাখায় উড়ে-যাওয়া দিনগুলি! এখন থেকে সামনে প্রসারিত নিরবকাশ কর্তব্যকঠোর মরুজীবন।

আজ ২৬শে ফাল্গুন। হোলিখেলার দিন। মফঃস্বলের কাজে এ খেলায় শশাঙ্কের সময় ছিল না, এদিনের কথা তারা ভুলেই গেছে। ঊর্মি আজ তার শয্যাগত দিদির পায়ে আবীরের টিপ দিয়ে প্রণাম করেছে। তার পরে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখলে, শশাঙ্ক আপিস-ঘরের ডেস্কে ঝুঁকে পড়ে একমনে কাজ করছে। পিছন থেকে গিয়ে দিলে তার মাথায় আবীর মাখিয়ে, রাঙিয়ে উঠল তার কাগজপত্র। মাতামাতির পালা পড়ে গেল। ডেস্কে ছিল দোয়াতে লাল কালি। শশাঙ্ক দিলে ঊর্মির শাড়িতে ঢেলে। হাত চেপে ধরে তার আঁচল থেকে ফাগ কেড়ে নিয়ে ঊর্মির মুখে দিলে ঘষে, তার পরে দৌড়াদৌড়ি, ঠেলাঠেলি, চেঁচামেচি। বেলা যায় চলে, স্নানাহারের সময় যায় পিছিয়ে, ঊর্মির উচ্চহাসির স্বরোচ্ছ্বাসে সমস্ত বাড়ি মুখরিত। শেষকালে শশাঙ্কের অস্বাস্থ্য-আশঙ্কায় দূতের পরে দূত পাঠিয়ে শর্মিলা এদের নিবৃত্ত করলে।
দিন গেছে। রাত্রি হয়েছে অনেক। পুষ্পিত কৃষ্ণচূড়ার শাখাজাল ছাড়িয়ে পূর্ণচাঁদ উঠেছে অনাবৃত আকাশে। হঠাৎ ফাল্গুনের দমকা হাওয়ায় ঝর্‌ঝর্‌ শব্দে দোলাদুলি করে উঠেছে বাগানের সমস্ত গাছপালা, তলাকার ছায়ার জাল তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে। জানলার কাছে ঊর্মি চুপ করে বসে। ঘুম আসছে না কিছুতেই। বুকের মধ্যে রক্তের দোলা শান্ত হয় নি। আমের বোলের গন্ধে মন উঠেছে ভরে। আজ বসন্তে মাধবীলতার মজ্জায় মজ্জায় যে ফুল ফোটাবার বেদনা সেই বেদনা যেন ঊর্মির সমস্ত দেহকে ভিতর থেকে উৎসুক করেছে। পাশের নাবার ঘরে গিয়ে মাথা ধুয়ে নিলে, গা মুছলে ভিজে তোয়ালে দিয়ে। বিছানায় শুয়ে এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে কিছুক্ষণ পরে স্বপ্নজড়িত ঘুমে আবিষ্ট হয়ে পড়ল।

রাত্রি তিনটের সময় ঘুম ভেঙেছে। চাঁদ তখন জানলার সামনে নেই। ঘরে অন্ধকার, বাইরে আলোয় ছায়ায় জড়িত সুপারিগাছের বীথিকা। ঊর্মির বুক ফেটে কান্না এল, কিছুতে থামতে চায় না। উপুড় হয়ে পড়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল। প্রাণের এই কান্না-- ভাষায় এর শব্দ নেই, অর্থ নেই। প্রশ্ন করলে ও কি বলতে পারে, কোথা থেকে এই বেদনার জোয়ার উদ্‌বেলিত হয়ে ওঠে ওর দেহে মনে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় দিনের কর্মতালিকা, রাত্রের সুখনিদ্রা?

সকালে ঊর্মি যখন ঘুম ভেঙে উঠল তখন ঘরের মধ্যে রৌদ্র এসে পড়েছে। সকালবেলাকার কাজে ফাঁক পড়ল, ক্লান্তির কথা মনে করে শর্মিলা ওকে ক্ষমা করেছে। কিসের অনুতাপে ঊর্মি আজ অবসন্ন। কেন মনে হচ্ছে, ওর হার হতে চলল। দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তো তোমার কোনো কাজ করতেই পারি নে-- বল তো বাড়ি ফিরে যাই!”

আজ তো শর্মিলা বলতে পারলে না ‘না, যাস নে’। বললে, “আচ্ছা, যা তুই। তোর পড়াশুনোর ক্ষতি হচ্ছে। যখন মাঝে মাঝে সময় পাবি দেখে-শুনে যাস।”

শশাঙ্ক তখন কাজে বেরিয়ে গেছে। সেই অবকাশে সেই দিনই ঊর্মি বাড়ি চলে গেল।

শশাঙ্ক সেদিন যান্ত্রিক ছবি আঁকার এক-সেট সরঞ্জাম কিনে বাড়ি ফিরলে। ঊর্মিকে দেবে, কথা ছিল তাকে এই বিদ্যেটা শেখাবে। ফিরে এসে তাকে যথাস্থানে না দেখতে পেয়ে শর্মিলার ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করল ,“ঊর্মি গেল কোথায়।”

শর্মিলা বললে, “এখানে তার পড়াশুনোর অসুবিধে হচ্ছে বলে সে বাড়ি চলে গেছে।”

“কিছু দিন অসুবিধে করবে বলে সে তো প্রস্তুত হয়েই এসেছিল। অসুবিধের কথা হঠাৎ আজই মনে উঠল কেন।”

কথার সুর শুনে শর্মিলা বুঝলে শশাঙ্ক তাকেই সন্দেহ করছে। সে সম্বন্ধে কোনো বৃথা তর্ক না করে বললে, “আমার নাম করে তুমি তাকে ডেকে নিয়ে এসো, নিশ্চয় কোনো আপত্তি করবে না।”

ঊর্মি বাড়িতে ফিরে এসে দেখলে, অনেক দিন পরে বিলেত থেকে ওর নামে নীরদের চিঠি এসে অপেক্ষা করছে। ভয়ে খুলতেই পারছিল না। মনে জানে, নিজের তরফে অপরাধ জমা হয়ে উঠেছে। নিয়মভঙ্গের কৈফিয়ত-স্বরূপ এর আগে দিদির রোগের উল্লেখ করেছিল। কিছুদিন থেকে কৈফিয়তটা প্রায় এসেছে মিথ্যে হয়ে। শশাঙ্ক বিশেষ জেদ করে শর্মিলার জন্যে দিনে একজন রাত্রে একজন নার্স নিযুক্ত করে দিয়েছে। ডাক্তারের বিধান-মতে রোগীর ঘরে সর্বদা আত্মীয়দের আনাগোনা তারা রোধ করে। ঊর্মি মনে জানে নীরদ দিদির রোগের কৈফিয়তটাকেও গুরুতর মনে করবে না; বলবে ‘ওটা কোন কাজের কথা নয়।’ বস্তুতই কাজের কথা নয়—‘আমাকে তো দরকার হচ্ছে না’। অনুতপ্তচিত্তে স্থির করলে, ‘এবারে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইব। বলব, আর কখনো ত্রুটি হবে না, কিছুতে নিয়মভঙ্গ করব না।’

চিঠি খোলবার আগে অনেক দিন পরে আবার বের করলে সেই ফোটোগ্রাফখানা। টেবিলের উপর রেখে দিলে। জানে ঐ বিটা দেখলে শশাঙ্ক খুব বিদ্রূপ করবে। তবু ঊর্মি কিছুতেই কুণ্ঠিত হবে না তার বিদ্রূপে; এই তার প্রায়শ্চিত্ত। নীরদের সঙ্গে ওর বিবাহ হবে এই প্রসঙ্গটা দিদিদের বাড়িতে ও চাপা দিত। অন্যেরাও তুলত না; কেননা এ প্রসঙ্গটা ওখানকার সকলের অপ্রিয়। আজ হাত মুঠো করে ঊর্মি স্থির করলে-- ওর সকল ব্যবহারেই এই সংবাদটা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করবে। কিছুদিন থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এন্‌গেজমেণ্ট্‌ আংটি। সেটা বের করে পরলে। আংটিটা নিতান্ত কম দামের-- নীরদ আপন অনেস্ট্‌ গরিবিয়ানার গর্বের দ্বারাই ঐ সস্তা আংটির দাম হীরের চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবখানা এই যে, ‘আংটির দামেই আমার দাম নয়, আমার দামেই আংটির দাম।’
নিজেকে যথাসাধ্য শোধন করে নিয়ে ঊর্মি অতি ধীরে লেফাফাটা খুললে।

চিঠিখানা পড়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছা করল নাচতে, কিন্তু নাচ ওর অভ্যাস নেই। সেতারটা ছিল বিছানার উপর, সেটা তুলে নিয়ে সুর না বেঁধেই ঝনাঝন ঝংকার দিয়ে যা-তা বাজাতে লাগল।

ঠিক এমন সময়ে শশাঙ্ক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলে, “ব্যাপারখানা কী। বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেল বুঝি?”

“হাঁ শশাঙ্কদা, স্থির হয়ে গেছে।”

“কিছুতেই নড়চড় হবে না?”

“কিছুতেই না।”

“তা হলে এইবেলা সানাই বায়না দিই, আর ভীমনাগের সন্দেশ?”

“তোমাকে কোনো চেষ্টা করতে হবে না।”

“নিজেই সব করবে? ধন্য বীরাঙ্গনা। আর, কনেকে আশীর্বাদ?”

“সে আশীর্বাদের টাকাটা আমার নিজের পকেট থেকেই গেছে।”

“মাছের তেলেই মাছভাজা? ভালো বোঝা গেল না।”

“এই নাও, বুঝে দেখো।”

বলে চিঠিখানা ওর হাতে দিলে।

পড়ে শশাঙ্ক হো হো করে হেসে উঠল।

লিখছে : যে রিসার্চের দুরূহ কাজে নীরদ আত্মনিবেদন করতে চায় ভারতবর্ষে তা সম্ভব নয়। সেইজন্যেই ওর জীবনে আর-একটা মস্ত স্যাক্রিফাইস মেনে নিতে হল। ঊর্মির সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন না করলে উপায় নেই। একজন য়ুরোপীয় মহিলা ওকে বিবাহ করে ওর কাজে আত্মদান করতে সম্মত। কিন্তু কাজটা সেই একই, ভারতবর্ষেই করা হোক আর এখানেই। রাজারামবাবু যে কাজের জন্য অর্থ দিতে চেয়েছিলেন তার কিয়দংশ সেখানে নিযুক্ত করলে অন্যায় হবে না। তাতে মৃতব্যক্তির ‘পরে সম্মান করাই হবে।

শশাঙ্ক বললে, “জীবিত ব্যক্তিটাকে কিছু কিছু দিয়ে যদি সেই দূরদেশেই দীর্ঘকাল জিইয়ে রাখতে পার তো মন্দ হয় না। টাকা বন্ধ করলে পাছে খিদের জ্বালায় মরিয়া হয়ে এখানে দৌড়ে আসে এই ভয় আছে।”

ঊর্মি হেসে বললে, “সে ভয় যদি তোমার মনে থাকে টাকা তুমিই দিয়ো, আমি এক পয়সাও দেব না।”

শশাঙ্ক বললে, “আবার তো মন বদল হবে না? মানিনীর অভিমান তো অটল থাকবে?”

“বদল হলে তোমার তাতে কী শশাঙ্কদা!”

“প্রশ্নের সত্য উত্তর দিলে অহংকার বেড়ে যাবে, অতএব তোমার হিতের জন্যে চুপ করে রইলুম। কিন্তু ভাবছি, লোকটার গণ্ডদেশ তো কম নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে চীক্‌।”
ঊর্মির মনের মধ্যে থেকে প্রকাণ্ড একটা ভার নেমে গেল--বহু দিনের ভার। মুক্তির আনন্দে ও কী যে করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। ওর সেই কাজের ফর্দটা ছিঁড়ে ফেলে দিলে। গলিতে ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইছিল, জানলা থেকে আংটিটা ছুঁড়ে ফেললে তার দিকে।

জিজ্ঞাসা করলে, “এই পেন্‌সিলের দাগ দেওয়া মোটা বইগুলো কি কোনো হকার কিনবে।”

“নাই যদি কেনে, তার ফলাফলটা কী আগে শুনি।”

“যদি ওর মধ্যে সাবেক কালের ভূতটা বাসা করে, মাঝে মাঝে অর্ধেক রাত্রে তর্জনী তুলে আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়।”

“সে আশঙ্কা যদি থাকে হকারের অপেক্ষা করব না, আমি নিজেই কিনব।”

“কিনে কী করবে।”

“হিন্দুশাস্ত্রমতে অন্ত্যেষ্টিসৎকার। গয়া পর্যন্ত যেতে রাজি, তাতে যদি তোমার মন সান্ত্বনা পায়।”

“না, অতটা বাড়াবাড়ি সইবে না।”

“আচ্ছা, আমার লাইব্রেরির কোণে পিরামিড বানিয়ে ওদের মামি করে রেখে দেব।”

“আজ কিন্তু তুমি কাজে বেরোতে পাবে না।”

“সমস্ত দিন?”

“সমস্ত দিনই।”

“কী করতে হবে।”

“মোটরে করে উধাও হয়ে যাব।”

“দিদির কাছে ছুটি নিয়ে এসো গে।”

“না, ফিরে এসে দিদিকে বলব, তখন খুব বকুনি খাব। সে বকুনি সইবে।”

“আচ্ছা, আমিও তোমার দিদির বকুনি হজম করতে রাজি। টায়ার যদি ফাটে দুঃখিত হব না। ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইল বেগে দুটো-চারটে মানুষ চাপা দিয়ে একেবারে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছতে আপত্তি নেই। কিন্তু তিন সত্যি দাও যে, মোটর-রথযাত্রা সাঙ্গ করে আমাদেরই বাড়িতে তুমি ফিরে আসবে।”

“আসব, আসব, আসব।”

মোটর-যাত্রার শেষে ভবানীপুরের বাড়িতে দুজন এল, কিন্তু ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইলের বেগ রক্ত থেকে এখনো কিছুতেই থামতে চায় না। সংসারের সমস্ত দাবি সমস্ত ভয়লজ্জা এই বেগের কাছে বিলুপ্ত হয়ে গেল।

কয়দিন শশাঙ্কের সব কাজ গেল ঘুলিয়ে। মনের ভিতরে ভিতরে সে বুঝেছে যে, এটা ভালো হচ্ছে না। কাজের ক্ষতি খুব গুরুতর হওয়াও অসম্ভব নয়। রাত্রে বিছনায়ায় শুয়ে শুয়ে দুর্ভাবনায় দুঃসম্ভাবনাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখে। কিন্তু পরের দিনে আবার সে স্বাধিকারপ্রমত্ত, মেঘদূতের যক্ষের মতন। মদ একবার খেলে তার পরিতাপ ঢাকতে আবার খেতে হয়। কিছু কাল এইরকম যায়। লাগল চোখে ঘোর, মন উঠল আবিল হয়ে।

নিজেকে সুস্পষ্ট বুঝতে ঊর্মির সময় লেগেছে, কিন্তু একদিন হঠাৎ চমকে উঠে বুঝলে।

মথুরদাদাকে ঊর্মি কী জানি কেন ভয় করত, এড়িয়ে বেড়াত তাকে। সেদিন মথুর সকালে দিদির ঘরে এসে বেলা দুপুর পর্যন্ত কাটিয়ে গেল।

তার পরে দিদি ঊর্মিকে ডেকে পাঠালে। মুখ তার কঠোর, অথচ শান্ত। বললে, “প্রতিদিন ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে কী কাণ্ড করেছিস জানিস তা?”

ঊর্মি ভয় পেয়ে গেল। বললে, “কী হয়েছে দিদি।”

দিদি বললে, “মথুরদাদা জানিয়ে গেল, কিছুদিন ধরে তোর ভগ্নীপতি নিজে কাজ একেবারে দেখেন নি। জহরলালের উপরে ভার দিয়েছিলেন; সে মালমসলায় দুহাত চালিয়ে চুরি করেছে। বড়ো বড়ো গুদামঘরের ছাদ একেবারে ঝাঁজরা; সেদিনকার বৃষ্টিতে ধরা পড়েছে মাল যাচ্ছে নষ্ট হয়ে। আমাদের কোম্পানির মস্ত নাম, তাই ওরা পরীক্ষা করে নি, এখন মস্ত অখ্যাতি এবং লোকসানের দায় পড়েছে ঘাড়ে। মথুরদাদা স্বতন্ত্র হবেন।”

ঊর্মির বুক ধক্‌ করে উঠল, মুখ হয়ে গেল পাঁশের মতো। এক মুহূর্তে বিদ্যুতের আলোয় আপন মনের প্রচ্ছন্ন রহস্য প্রকাশ পেলে। স্পষ্ট বুঝলে, কখন অজ্ঞাতসারে তার মনের ভিতরটা উঠেছিল মাতাল হয়ে, ভালোমন্দ কিছুই বিচার করতে পারে নি। শশাঙ্কর কাজটাই যেন ছিল তার প্রতিযোগী, তারই সঙ্গে ওর আড়াআড়ি। কাজের থেকে ওকে ছাড়িয়ে নিয়ে সর্বদা সম্পূর্ণ কাছে পাবার জন্যে ঊর্মি কেবল ভিতরে ভিতরে ছট্‌ফট্‌ করত। কতদিন এমন ঘটেছে, শশাঙ্ক যখন স্নানে এমন সময় কাজের কথা নিয়ে লোক এসেছে; ঊর্মি কিছু না ভেবে বলে পাঠিয়েছে, “বল্‌ গে, এখন দেখা হবে না।”

ভয়, পাছে স্নান করে এসেই শশাঙ্ক আর অবকাশ না পায়, পাছে এমন করে কাজে জড়িয়ে পড়ে যে ঊর্মির দিনটা হয় ব্যর্থ। তার দুরন্ত নেশার সাংঘাতিক ছবিটা সম্পূর্ণ চোখে জেগে উঠল। তৎক্ষণাৎ দিদির পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ল। বার বার করে রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলতে লাগল, “তাড়িয়ে দাও তোমাদের ঘর থেকে আমাকে, এখনই দূর করে তাড়িয়ে দাও।”

আজ দিদি নিশ্চিত স্থির করে বসেছিল, কিছুতেই ঊর্মিকে ক্ষমা করবে না। মন গেল গলে।

আস্তে আস্তে ঊর্মিমালার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, “কিছু ভাবিস নে, যা হয় একটা উপায় হবে।”

ঊর্মি উঠে বসল। বললে, “দিদি, তোমাদেরই বা কেন লোকসান হবে। আমারও তো টাকা আছে।”

শর্মিলা বললে, “পাগল হয়েছিস। আমার বুঝি কিছু নেই। মথুরদাদাকে বলেছি, এই নিয়ে তিনি যেন কিছু গোল না করেন। লোকসান আমি পুরিয়ে দেব। আর, তোকেও বলছি, আমি যে কিছু জানতে পেরেছি এ কথা যেন তোর ভগ্নীপতি না টের পান।”

“মাপ করো, দিদি, আমাকে মাপ করো” এই বলে ঊর্মি আবার দিদির পায়ের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল।

শর্মিলা চোখের জল মুছে ক্লান্ত সুরে বললে, “কে কাকে মাপ করবে, বোন। সংসারটা বড়ো জটিল। যা মনে করি তা হয় না, যার জন্যে প্রাণপণ করি তা যায় ফেঁসে।”

দিদিকে ছেড়ে ঊর্মি এক মুহূর্ত নড়তে চায় না-- ওষুধপত্র দেওয়া, নাওয়ানো, খাওয়ানো, শোওয়ানো সমস্ত খুঁটিনাটি নিজের হাতে। আবার বই পড়তে আরম্ভ করেছে, সেও দিদির বিছানার পাশে বসে। নিজেকেও আর বিশ্বাস করে না, শশাঙ্ককেও না।

ফল হল এই যে, শশাঙ্ক বার বার আসে রোগীর ঘরে। পুরুষমানুষের অন্ধতাবশতই বুঝতে পারে না ছট্‌ফটানির তাৎপর্য স্ত্রীর কাছে পড়ছে ধরা, লজ্জায় মরছে ঊর্মি। শশাঙ্ক আসে মোহনবাগান ফুটবল ম্যাচের প্রলোভন নিয়ে, ব্যর্থ হয়। পেন্‌সিলের দাগ-দেওয়া খবরের কাগজ মেলে দেখায় বিজ্ঞাপনে চার্লি চ্যাপলিনের নাম, ফল হয় না কিছুই। ঊর্মি যখন দুর্লভ ছিল না তখনো বাধার ভিতর দিয়ে শশাঙ্ক কাজকর্ম চালাতে চেষ্টা করত। এখন অসম্ভব হয়ে এল।
হতভাগার এই নিরর্থক নিপীড়নে প্রথম প্রথম শর্মিলা বড়ো দুঃখেও সুখ পেত। কিন্তু ক্রমে দেখলে ওর যন্ত্রণা উঠছে প্রবল হয়ে, মুখ গেছে শুকিয়ে, চোখের নীচে পড়ছে কালি। ঊর্মি খাওয়ার সময় কাছে বসে না, সেজন্য শশাঙ্কর খাওয়ার উৎসাহ এবং পরিমাণ কমে যাচ্ছে তা ওকে দেখলে বোঝা যায়। সম্প্রতি হঠাৎ এ বাড়িতে আনন্দের যে বান ডেকে এসেছিল সেটা গেছে সম্পূর্ণ ভাঁটিয়ে, অথচ পূর্বে ওদের যে একটা সহজ দিনযাত্রা ছিল সেও রইল না।

একদা শশাঙ্ক নিজের চেহারার চর্চায় উদাসীন ছিল। নাপিতকে দিয়ে চুল ছাঁটাত প্রায় ন্যাড়া করে। আঁচড়াবার প্রয়োজন ঠেকেছিল সিকির সিকিতে। শর্মিলা তাই নিয়ে অনেকবার প্রবল বাগ্‌বিতণ্ডা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ইদানীং ঊর্মির উচ্চহাস্যসংযুক্ত সংক্ষিপ্ত আপত্তি নিষ্ফল হয় নি। নূতন সংস্করণের কেশোদ্‌গমের সঙ্গে সুগন্ধি তৈলের সংযোগসাধন শশাঙ্কর মাথায় এই প্রথম ঘটল। কিন্তু তার পর আজকাল কেশোন্নতিবিধানের অনাদরেই ধরা পড়ছে অন্তর্‌বেদনা। এতটা বেশি যে, এ নিয়ে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য তীব্র হাসি আর চলে না। শর্মিলার উৎকণ্ঠা তার ক্ষোভকে ছাড়িয়ে গেল। স্বামীর প্রতি করুণায় ও নিজের প্রতি ধিক্‌কারে তার বুকের মধ্যে টন্‌টন্‌ করে উঠছে, রোগের ব্যথাকে দিচ্ছে এগিয়ে।

ময়দানে হবে কেল্লার ফৌজদের যুদ্ধের খেলা। শশাঙ্ক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে এল, “যাবে ঊর্মি, দেখতে? ভালো জায়গা ঠিক করে রেখেছি।”

ঊর্মি কোনো উত্তর দেবার পূর্বেই শর্মিলা বলে উঠল, “যাবে বৈকি। নিশ্চয় যাবে। একটু বাইরে ঘুরে আসবার জন্যে ও যে ছট্‌ফট্‌ করছে।”

প্রশ্রয় পেয়ে দুদিন না যেতেই জিজ্ঞাসা করলে, “সার্কাস?”

এ প্রস্তাবে ঊর্মিমালার উৎসাহই দেখা গেল।

তার পরে, “বোটানিকাল গার্ডেন?”

এইটেতে একটু বাধল। দিদিকে ফেলে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে ঊর্মির মন সায় দিচ্ছে না।

দিদি স্বয়ং পক্ষ নিল শশাঙ্কর। রাজ্যের রাজমজুরদের সঙ্গে দিনে দুপুরে ঘুরে ঘুরে খেটে খেটে মানুষটা যে হয়রান হল-- সারা দিন কেবল খাটছে ধুলোবালির মধ্যে। হাওয়া না খেয়ে এলে শরীর যে পড়বে ভেঙে।

এই একই যুক্তি অনুসারে স্টীমারে করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ঘুরে আসা অসংগত হল না।

শর্মিলা মনে মনে বলে, যার জন্যে কাজ খোওয়াতে ওর ভাবনা নেই তাকে সুদ্ধ খোওয়ানো ওর সইবে না।

শশাঙ্ককে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলে নি বটে, কিন্তু চারি দিক থেকেই সে একটা অব্যক্ত সমর্থন পাচ্ছে। শশাঙ্ক একরকম ঠিক করে নিয়েছে, শর্মিলার মনে বিশেষ কোনো ব্যথা নেই, ওদের দুজনকে একত্র মিলিয়ে খুশি দেখেই সে খুশি। সাধারণ মেয়ের পক্ষে এটা সম্ভব হতে পারত না, কিন্তু শর্মিলা যে অসাধারণ। শশাঙ্কর চাকরির আমলে একজন আর্টিষ্ট্‌ রঙিন পেন্‌সিল দিয়ে শর্মিলার একটা ছবি এঁকেছিল। এত দিন সেটা ছিল পোর্ট্‌ফোলিয়োর মধ্যে। সেইটেকে বের করে বিলিতি দোকানে খুব দামি ফ্যাশানে বাঁধিয়ে নিয়ে আপিস-ঘরে যেখানে বসে ঠিক তার সমুখে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখলে। সামনে ফুলদানিতে রোজ মালী ফুল দিয়ে যায়।

অবশেষে একদিন শশাঙ্ক বাগানে সূর্যমুখী কিরকম ফুটছে দেখাতে দেখাতে হঠাৎ ঊর্মির হাত চেপে ধরে বললে, “তুমি নিশ্চয় জান, তোমাকে আমি ভালোবাসি; আর, তোমার দিদি, তিনি তো দেবী। তাঁকে যত ভক্তি করি জীবনে আর-কাউকে তেমন করি নে। তিনি পৃথিবীর মানুষ নন, তিনি আমাদের অনেক উপরে।”

এ কথা দিদি বার বার করে ঊর্মিকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তার অবর্তমানে সব চেয়ে যেটা সান্ত্বনার বিষয় সে ঊর্মিকে নিয়েই। এ সংসারে অন্য কোনো মেয়ের আবির্ভাব কল্পনা করতেও দিদিকে বাজত, অথচ শশাঙ্ককে যত্ন করবার জন্যে কোনো মেয়েই থাকবে না এমন লক্ষ্মীছাড়া অবস্থাও দিদি মনে মনে সইতে পারত না। ব্যাবসার কথাও দিদি ওকে বুঝিয়েছে; বলেছে, যদি ভালোবাসায় বাধা পায় তা হলে সেই ধাক্কায় ওর কাজকর্ম সব যাবে নষ্ট হয়ে। ওর মন যখন তৃপ্ত হবে তখনই আবার কাজকর্মে আপনি আসবে শৃঙ্খলা।

শশাঙ্কের মন উঠেছে মেতে। ও এমন একটা চন্দ্রলোকে আছে যেখানে সংসারের সব দায়িত্ব সুখতন্দ্রায় লীন। আজকাল রবিবার-পালনে বিশুদ্ধ খৃস্টানের মতোই ওর অস্খলিত নিষ্ঠা। একদিন শর্মিলাকে গিয়ে বললে, “দেখো, পাটের সাহেবদের কাছে তাদের স্টীমলঞ্চ পাওয়া গেছে-- কাল রবিবার, মনে করছি ভোরে ঊর্মিকে নিয়ে ডায়মণ্ডহারবারের কাছে যাব, সন্ধ্যার আগেই আসব ফিরে।”

শর্মিলার বুকের শিরাগুলো কে যেন দিলে মুচড়ে, বেদনায় কপালের চামড়া উঠল কুঞ্চিত হয়ে। শশাঙ্কের চোখেই পড়ল না।

শর্মিলা কেবল একবার জিজ্ঞাসা করলে, “খাওয়াদাওয়ার কী হবে।”

শশাঙ্ক বললে, “হোটেলের সঙ্গে ঠিক করে রেখেছি।”

একদিন এই-সমস্ত ঠিক করবার ভার যখন ছিল শর্মিলার উপর তখন শশাঙ্ক ছিল উদাসীন। আজ সমস্ত উলটপালট হয়ে গেল।

যেমনি শর্মিলা বললে, “আচ্ছা, তা যেয়ো” অমনি মুহূর্ত অপেক্ষা না করে শশাঙ্ক বেরিয়ে গেল ছুটে। শর্মিলার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করল। বালিশের মধ্যে মুখ গুঁজে বার বার করে বলতে লাগল, “আর কেন আছি বেঁচে।”

কাল রবিবারে ছিল ওদের বিবাহের সাম্বৎসরিক। আজ পর্যন্ত এ অনুষ্ঠানে কোনো দিন ছেদ পড়ে নি। এবারেও স্বামীকে না বলে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমস্ত আয়োজন করছিল। আর-কিছুই নয়, বিয়ের দিন শশাঙ্ক যে লাল বেনারসির জোড় পরেছিল সেইটে ওকে পরাবে, নিজে পরবে বিয়ের চেলি। স্বামীর গলায় মালা পরিয়ে ওকে খাওয়াবে সামনে বসিয়ে-- জ্বালাবে ধূপবাতি, পাশের ঘরে গ্রামোফোনে বাজবে সানাই। অন্যান্য বছর শশাঙ্ক ওকে আগে থাকতে না জানিয়ে একটা-কিছু শখের জিনিস কিনে দিত। শর্মিলা ভেবেছিল ‘এবারেও নিশ্চয় দেবে, কাল পাব জানতে।’

আজ ও আর কিছুই সহ্য করতে পারছে না। ঘরে যখন কেউ নেই তখন কেবলই বলে বলে উঠছে, “মিথ্যে! মিথ্যে! মিথ্যে! কী হবে এই খেলায়?”

রাত্রে ঘুম হল না। ভোরবেলা শুনতে পেলে মোটর-গাড়ি দরজার কাছ থেকে চলে গেল। শর্মিলা ফুঁপিয়ে উঠে কেঁদে বললে, “ঠাকুর, তুমি মিথ্যে।”

এখন থেকে রোগ দ্রুত বেড়ে চলল। দুর্লক্ষণ যেদিন অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠেছে সেদিন শর্মিলা ডেকে পাঠালে স্বামীকে। সন্ধ্যাবেলা, ক্ষীণ আলো ঘরে, নার্সকে সংকেত করলে চলে যেতে। স্বামীকে পাশে বসিয়ে হাতে ধরে বললে, “জীবনে আমি যে বর পেয়েছিলুম ভগবানের কাছে সে তুমি। তার যোগ্য শক্তি আমাকে দেন নি। সাধ্যে যা ছিল করেছি। ত্রুটি অনেক হয়েছে, মাপ কোরো আমাকে।”

শশাঙ্ক কী বলতে যাচ্ছিল, বাধা দিয়ে বললে, “না, কিছু বোলো না। ঊর্মিকে দিয়ে গেলুম তোমার হাতে। সে আমার আপন বোন। তার মধ্যে আমাকেই পাবে, আরো অনেক বেশি পাবে যা আমার মধ্যে পাও নি। না, চুপ করো, কিছু বোলো না। মরবার কালেই আমার সৌভাগ্য পূর্ণ হল, তোমাকে সুখী করতে পারলুম।”

নার্স বাইরে থেকে বললে, “ডাক্তারবাবু এসেছেন।”

শর্মিলা বললে, “ডেকে দাও।”

কথাটা বন্ধ হয়ে গেল।

শর্মিলার মামা যতরকম অশাস্ত্রীয় চিকিৎসার সন্ধানে উৎসাহী। সম্প্রতি এক সন্ন্যাসীর সেবায় তিনি নিযুক্ত। যখন ডাক্তাররা বললে আর-কিছু করবার নেই তখন তিনি ধরে পড়লেন, হিমালয়ের ফেরত বাবাজির ওষুধ পরীক্ষা করতে হবে। কোন্‌ তিব্বতি শিকড়ের গুঁড়ো আর প্রচুর পরিমাণে দুধ, এই হচ্ছে উপকরণ।

শশাঙ্ক কোনোরকম হাতুড়েদের সহ্য করতে পারত না। সে আপত্তি করলে। শর্মিলা বললে, “আর কোনো ফল হবে না, অন্তত মামা সান্ত্বনা পাবেন।”

দেখতে দেখতে ফল হল। নিশ্বাসের কষ্ট কমেছে, রক্ত ওঠা গেল বন্ধ হয়ে।

সাত দিন যায়, পনেরো দিন যায়, শর্মিলা উঠে বসল। ডাক্তার বললে, মৃত্যুর ধাক্কাতেই অনেক সময় শরীর মরিয়া হয়ে উঠে শেষ ঠেলায় আপনাকে আপনি বাঁচিয়ে তোলে।

শর্মিলা বেঁচে উঠল।

তখন সে ভাবতে লাগল, ‘এ কী আপদ! কী করি! শেষকালে বেঁচে ওঠাই কি মরার বাড়া হয়ে দাঁড়াবে।’

ও দিকে ঊর্মি জিনিসপত্র গোছাচ্ছে। এখানে তার পালা শেষ হল।

দিদি এসে বললে, “তুই যেতে পারবি নে।”

“সে কী কথা।”

“হিন্দুসমাজে বোন-সতিনের ঘর কি কোনো মেয়ে কোনো দিন করে নি।”

“ছিঃ!”

“লোকনিন্দা! বিধির বিধানের চেয়ে বড়ো হবে লোকের মুখের কথা!”

শশাঙ্ককে ডাকিয়ে বললে, “চলো আমরা যাই নেপালে। সেখানে রাজ-দরবারে তোমার কাজ পাবার কথা হয়েছিল--চেষ্টা করলেই পাবে। সে দেশে কোনো কথা উঠবে না।”

শর্মিলা কাউকে দ্বিধা করবার অবকাশ দিল না। যাবার আয়োজন চলছে। ঊর্মি তবু বিমর্ষ হয়ে কোণে কোণে লুকিয়ে বেড়ায়।

শশাঙ্ক তাকে বললে, “আজ যদি তুমি আমাকে ছেড়ে যাও তা হলে কী দশা হবে ভেবে দেখো।”

ঊর্মি বললে, “আমি কিছু ভাবতে পারি নে। তোমরা দুজনে যা ঠিক করবে তাই হবে।”

গুছিয়ে নিতে কিছুদিন লাগল। তার পর সময় যখন কাছে এসেছে ঊর্মি বললে, “আর দিন-সাতেক অপেক্ষা করো, কাকাবাবুর সঙ্গে কাজের কথা শেষ করে আসি গে।”

চলে গেল ঊর্মি।

এই সময়ে মথুর এল শর্মিলার কাছে মুখ ভার করে। বললে, “তোমরা চলে যাচ্ছ ঠিক সময়েই। তোমার সঙ্গে কথাবার্তা স্থির হয়ে যাবার পরেই আমি আপসে শশাঙ্কের জন্যে কাজ বিভাগ করে দিয়েছিলেম। আমার সঙ্গে ওর লাভলোকসানের দায় জড়িয়ে রাখি নি। সম্প্রতি কাজ গুটিয়ে নেবার উপলক্ষে শশাঙ্ক কদিন ধরে হিসাব বুঝে নিচ্ছিল। দেখা গেল তোমার টাকা সম্পূর্ণ ডুবেছে। তা ছাপিয়েও যা দেনা জমেছে তাতে বোধ হয় বাড়ি বিক্রি করতে হবে।”

শর্মিলা জিজ্ঞাসা করলে, “সর্বনাশ এত দূর এগিয়ে চলেছিল-- উনি জানতে পারেন নি!”

মথুর বললে, “সর্বনাশ-জিনিসটা অনেক সময় বাজ পড়ার মতো, যে মুহূর্তে মারে তার আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ জানান দেয় না। ও বুঝেছিল ওর লোকসান হয়েছে। তখনো অল্পেই সামলে নেওয়া যেত। কিন্তু দুর্বুদ্ধি ঘটল; ব্যাবসার গলদ তাড়াতাড়ি শুধরে নেবে মনে করে আমাকে লুকিয়ে পাথুরে কয়লার হাটে তেজিমন্দি খেলা শুরু করলে। চড়ার বাজারে যা কিনেছে সস্তার বাজারে তাই বেচে দিতে হল। হঠাৎ আজ দেখলে হাউইয়ের মতো ওর সব গেছে উড়ে পুড়ে, বাকি রইল ছাই। এখন ভগবানের কৃপায় নেপালে কাজ পেলে তোমাদের ভাবতে হবে না।”
শর্মিলা দৈন্যকে ভয় করে না। বরঞ্চ ও জানে, অভাবের দিনে স্বামীর সংসারে ওর স্থান আরো বেড়ে যাবে। দারিদ্র্যের কঠোরতাকে যথাসম্ভব মৃদু করে এনে দিন চালাতে পারবে, এ বিশ্বাস ওর আছে। বিশেষত গয়না যা হাতে রইল তা নিয়ে এখনো কিছুকাল বিশেষ দুঃখ পেতে হবে না। এ কথাটাও সসংকোচে মনে উঁকি মেরেছে যে, ঊর্মির সঙ্গে বিয়ে হলে তার সম্পত্তিও তো স্বামীরই হবে। কিন্তু শুধু জীবনযাত্রাই তো যথেষ্ট নয়। এত দিন ধরে নিজের শক্তিতে নিজের হাতে স্বামী যে সম্পদ সৃষ্টি করে তুলেছিল, যার খাতিরে আপন হৃদয়ের অনেক প্রবল দাবিকেও শর্মিলা ইচ্ছে করে দিনে দিনে ঠেকিয়ে রেখেছে, সেই ওদের উভয়ের সম্মিলিত জীবনের মূর্তিমান আশা আজ মরীচিকার মতো মিলিয়ে গেল, এরই অগৌরব ওকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে। মনে মনে বলতে লাগল, তখনই যদি মরতুম তা হলে তো এই ধিক্‌কারটা বাঁচত আমার। আমার ভাগ্যে যা ছিল তা তো হল, কিন্তু দৈন্য-অপমানের এই নিদারুণ শূন্যতা একদিন কি পরিতাপ আনবে না ওঁর মনে। যার মোহে অভিভূত হয়ে এটা ঘটতে পারল একদিন হয়তো তাকে মাপ করতে পারবেন না, তার দেওয়া অন্ন ওঁর মুখে বিষ ঠেকবে। নিজের মাতলামির ফল দেখে লজ্জা পাবেন, কিন্তু দোষ দেবেন মদিরাকে। যদি অবশেষে ঊর্মির সম্পত্তির উপর নির্ভর করা অবশ্য হয়ে ওঠে তা হলে সেই আত্মাবমাননার ক্ষোভে ঊর্মিকে মুহূর্তে মুহূর্তে জ্বালিয়ে মারবেন।


এ দিকে মথুরের সঙ্গে সমস্ত হিসেবপত্র শোধ করতে গিয়ে শশাঙ্ক হঠাৎ জানতে পেরেছে যে শর্মিলার সমস্ত টাকা ডুবেছে তার ব্যবসায়ে। এ কথা শর্মিলা এত দিন তাকে জানায় নি, মিটমাট করে নিয়েছিল মথুরের সঙ্গে।

শশাঙ্কের মনে পড়ল, চাকরির অন্তে সে একদিন শর্মিলার টাকা ধার নিয়েই গড়ে তুলেছিল তার ব্যাবসা। আজ নষ্ট ব্যাবসার অন্তে সেই শর্মিলারই ঋণ মাথায় করে চলেছে সে চাকরিতে। এ ঋণ তো আর নামাতে পারবে না। চাকরির মাইনে দিয়ে কোনো কালে শোধ হবার রাস্তা কই।

আর দিন-দশেক বাকি আছে নেপাল-যাত্রার। সমস্ত রাত ঘুমোতে পারে নি। ভোরবেলায় শশাঙ্ক ধড়্‌ফড়্‌ করে বিছানা থেকে উঠেই আয়নার টেবিলের উপরে হঠাৎ সবলে মুষ্টিঘাত করে বলে উঠল, “যাব না নেপাল।” দৃঢ় পণ করলে, ‘আমরা দুজনে ঊর্মিকে নিয়ে কলকাতাতেই থাকব-- ভ্রূকুটিকুটিল সমাজের ক্রূর দৃষ্টির সামনেই। আর, এইখানেই ভাঙা ব্যাবসাকে আর-একবার গড়ে তুলব এই কলকাতাতেই বসে।’

যে-যে জিনিস সঙ্গে যাবে, যা রেখে যেতে হবে, শর্মিলা বসে বসে তারই ফর্দ করছিল একটা খাতায়। ডাক শুনতে পেলে, “শর্মিলা! শর্মিলা!” তাড়াতাড়ি খাতা ফেলে ছুটে গেল স্বামীর ঘরে। অকস্মাৎ অনিষ্টের আশঙ্কা করে কম্পিতহৃদয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “কী হয়েছে।”

বললে, “যাব না নেপালে। গ্রাহ্য করব না সমাজকে। থাকব এইখানেই।”

শর্মিলা জিজ্ঞাসা করলে, “কেন, কী হয়েছে।”

শশাঙ্ক বললে, “কাজ আছে।” সেই পুরাতন কথা-- কাজ আছে। শর্মিলার বুক দুরুদুর করে উঠল। 

“শর্মি, ভেবো না আমি কাপুরুষ। দায়িত্ব ফেলে পালাব আমি, এত অধঃপতন কল্পনা করতেও পার?”

শর্মিলা কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বললে, “কী হয়েছে আমাকে বুঝিয়ে বলো।”

শশাঙ্ক বললে, “আবার ঋণ করেছি তোমার কাছে, সে কথা ঢাকা দিয়ো না।”

শর্মিলা বললে, “আচ্ছা, বেশ।”

শশাঙ্ক বললে, “সেইদিনকার মতোই আজ থেকে আবার ঋণ শোধ করতে বসলুম। যা ডুবিয়েছি আবার তাকে টেনে তুলবই এই রইল কথা, শুনে রাখো। একদিন যেমন তুমি আমাকে বিশ্বাস করেছিলে তেমনি আবার আমাকে বিশ্বাস করো।”

শর্মিলা স্বামীর বুকের উপর মাথা রেখে বললে, “তুমিও আমাকে বিশ্বাস কোরো। কাজ বুঝিয়ে দিয়ো আমাকে, তৈরি করে নিয়ো আমাকে, তোমার কাজের যোগ্য যাতে হতে পারি সেই শিক্ষা আজ থেকে আমাকে দাও।”


বাইরে থেকে আওয়াজ এল “চিঠি”। ঊর্মির হাতের অক্ষরে দুখানা চিঠি। একখানি শশাঙ্কের নামে--

আমি এখন বোম্বাইয়ের রাস্তায়। চলেছি বিলেতে। বাবার আদেশমত ডাক্তারি শিখে আসব। ছয়-সাত বছর লাগবার কথা। তোমাদের সংসারে এসে যা ভাঙচুর করে গেলুম ইতিমধ্যে কালের হাতে আপনিই তা জোড়া লাগবে। আমার জন্যে ভেবো না, তোমার জন্যই ভাবনা রইল মনে।


শর্মিলার চিঠি—

দিদি, শতসহস্র প্রণাম তোমার পায়ে। অজ্ঞানে অপরাধ করেছি, মাপ কোরো। যদি সেটা অপরাধ না হয় তবে তাই জেনেই সুখী হব। তার চেয়ে সুখী হবার আশা রাখব না মনে। কিসে সুখ তাই বা নিশ্চিত কী জানি। আর, সুখ যদি না হয় তো নাই হল। ভুল করতে ভয় করি।


No comments

Powered by Blogger.