হিজাব.....
সেদিন আমি অনেক কেঁদেছিলাম।
আমি বরাবরই শালীন ভাবে চলি,যদিও আমার পরিবার খুব একটা ইসলামিক না।আমি ছোট থেকেই ছেলেদের সামনে যেতে, কথা বলতে লজ্জা করতাম।
পর্দা না করলেও আমি সবসময় মাথায় ওড়না জড়িয়ে রাখতাম।
নামাজ যদিও পাঁচ ওয়াক্ত পড়তাম না।কারণ তখন এতোটা বুঝতাম না।কিন্তু আল্লাহর সাথে আন্তরিকতা ছিলো।আমি মনে মনে সবমসময় আল্লাহর সাথে কথা বলতাম।জানি না ছোট্টমনে আল্লাহ কিভাবে আপন হয়ে গেছিল।
-
এভাবেই চলছিল।আমি যখন ক্লাস সেভেন এ তখন আমার একটা হিন্দু বান্ধবী হয়।তবে আমরা খুবই ফ্রি ছিলাম।দুজন দুজনের খাবারও শেয়ার করে খেতাম।ওর নাম বিপাশা।
তো একদিন বিপাশার বোন আসার কথা ছিলো স্কুলে টিফিন দিতে, এজন্য আমরা গেইট এর কাছে অপেক্ষা করছিলাম।
হঠাৎ দেখি একটা বোরখা পরা মেয়ে।
বিপাশা তাকে দিদি বলে ডাকছে।আমি অবাক হলাম।
ওকে জিগ্যেস করতে ও বললো এইটা ওর মেজোদিদি।
আমি আরোও অবাক হলাম।কারণ আমার জানামতে হিন্দু মেয়েরা বোরখা পরে না।
-
কৌতুহল চেপে রেখে পরে এ বিষয়ে বিপাশাকে জিগ্যেস করলাম।
মানে ওর আপুর বোরখা পরার কারণ কি?
বিপাশা বলল ওর আপু দেখতে সুন্দর, এজন্য পাড়ার বখাটেরা বিরক্ত করে,তাই ওর আপু বাহিরে আসলে বোরখা পরে আসে যাতে কেউ চিনতে না পারে।
তাছাড়া ওর আপুর নাকি বোরখা পোশাকটা ভালোও লাগে।
কথাগুলো শুনে আমার ভিতরে তোলপাড় করে উঠলো।
-
একটা হিন্দু মেয়ে বোরখা পরছে নিজেকে রক্ষা করার তাগিদে।অথচ আমরা মুসলিম মেয়ে হয়েও বোরখা পরি না।যদিও আমাদের রবই আমাদের পর্দা করার নির্দেশ দিয়েছে।
আমি সেদিন বাড়িতে এসেই বোরখা পরার বায়না করলাম।
আম্মু,চাচীরা,চাচাতো বোনরা বোঝালো এতো ছোট বয়সে বোরখা পরলে কদিন পর বিরক্ত হয়ে ছেড়ে দিতে চায়বি,এটা ঠিক হবে না।তারচেয়ে বড় হয়ে বিয়ের পর পরিস।
কে শোনে কার কথা আমি তো কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম,আমার বোরখা চায়ই চাই।
-
আমাকে এতো বুঝিয়েও যখন কাজ হলো না,তখন আমার এক চাচাতো বোন আমায় তার একটা পুরোনো বোরখা গিফ্ট করলো।(আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিক)।আর বলা হলো যদি আমি ঠিকভাবে একবছর পরতে পারি তাহলে পরে আবার বোরখা কিনে দেওয়া হবে।
আমি ওই একবছর সবজায়গায় বোরখা পরে যেতাম।এজন্যও বাধা আসতো।বাড়ির লোকজন বলত শুধু স্কুলে পরে যেতে।যদিও আমি আত্মীয়ের বাড়িতে যেয়ে বোরখা খুলে রাখতাম।
তবুও আমি কারো কথা শুনতাম না।
প্রথম প্রথম বোরখা পরা দেখে বান্ধবীরা নাক সিটকাতো।ছুটির সময় বোরখা পরার কারণে দেরী হলে ওরা চলে আসতে চায়তো।
-
এভাবে আরও কয়েক বছর পার হয়ে গেলো।
স্কুল কলেজ পার করে অনার্স লেভেলে ভর্তি হলাম।
ফেসবুকে কিছু দ্বীনি বোনের সাথে পরিচয় হলো।
ওদের থেকে বুঝতে পারলাম আমার পর্দা টা সঠিকভাবে হচ্ছে না।
হাত মোজা,পা মোজা, খিমারসহ পর্দা শুরু করলাম।
এবার আসল বিপত্তি।
কলেজে গেলে সবাই ভুত দেখার মত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।মেয়েদের পাশে দাড়ালে তারা সরে দাড়ায়,হয়তো জঙ্গি ভাবে।
সবাই এমন করে মনে হয় আমি এ্যালিয়েন,অন্য গ্রহ থেকে আসছি।কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে বলে এতো পর্দা তো পড়ালেখা করার কি দরকার?
কারো সাথে অহেতুক কথা বলি না তাই জবাব টা দেওয়া হয় না।
কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিপূর্ণ পর্দা অবস্থায় গেলে
সবাই টিটকারি মারে,হাসাহাসি করে।সব মুখ বুজে সহ্য করি।
-
কিন্তু সেদিন......
সেদিন ছিলো আমার অনার্স লেভেলের ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা।
আমি যথারীতি পরিপূর্ণ পর্দাসহ পরীক্ষা হলে প্রবেশ করেছি।নিজের সিটে বসে মাত্রই পরীক্ষা দেওয়া শুরু করেছি।হঠাৎ একটা প্রফেসর আসলেন রুমে।
- এই মেয়ে তুমি এভাবে আসছো কেন পরীক্ষা হলে?
পর্দা বাড়িতে করবা এখানে কি?পরীক্ষা রেখে কার সময় আছে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।যত্তসব।
এখনি এইসব খুলো নয়তো রুম থেকে বাহির হয়ে যাও।
আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নিলাম।দুফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল।কলম গুলো গুছিয়ে, রেজিস্ট্রেশন আর এডমিট কার্ড টা হাতে উঠে পড়লাম।
-
হায়তো স্যারটা অবাক হয়ছিলো।আমি আরোও অবাক করার জন্য হনহন করে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলাম।
কেউই হয়তো ভাবেনি আমি এমন করব।
বাড়িতে এসে সবাই আমাকেই বকছিলো।কেন আমি এতো পর্দা করি। তাদের কথা কাঁটা ঘায়ে নুননের ছিটার মমত লাগছিলো।খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।শুধুমাত্র এটা ভেবে, পরীক্ষা হলে একটাও হিন্দু ছেলে মেয়ে ছিলো না।তবুও কেউ স্যারের কথার একটা প্রতিবাদ করলো না।অনেক ছেলের মুখে দাঁড়ি,কয়েকজন পাঞ্জাবী পরেও এসেছে তবুও স্যার তাদের কে কিছু বলেনি।
কান্না পাচ্ছিল খুব, আমার মুসলিম ভাইয়েরাও আমার পাশে এসে দাড়ালো না।
-
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আর পড়ালেখায় করবো না।
হঠাৎ আমার স্মরণ হলো মাদ্রাসার কথা।
আমি বাড়িতে বলে দিলাম সে কথা।কেউ রাজি হচ্ছিল না।সবাই বলছে মাদ্রাসায় সন্ত্রাস রা পড়ে।আমি বললাম ঠিক আছে আমি না হয় সন্ত্রাসই হবো।তারপর ওই প্রভাষকের উপর বদলা নিব।
আমাকে আল্লাহর হুকুম পালনে বাধা দিয়েছে,ওর কত্ত বড় সাহস।
আল্লাহর হুকুম পালন করলে যদি সন্ত্রাস অপবাদ শোনা লাগে তাও ঢের ভালো।কাপুরুষ মুসলমান তো হবো না।
শেষমেষ আমাকে ভালো একটা মহিলা মাদ্রাসায় ভর্তি করা হলো।
আলহামদুলিল্লাহ এখন আমি শান্তিমত আল্লাহর ইবাদত করতে পারি,কেউ বাধা দেয় না।
#আল্লাহর_কাছে_আসার_গল্প
No comments