মাথিনের কুপ: এক ট্যাজিক প্রেমের ঊপাখ্যান
মাথিনের কুপ: এক ট্যাজিক প্রেমের ঊপাখ্যান
লেখক: James Liton Halder
আজ ১০ ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল, ২৭শে মাঘ, ১৪২৬ বংগাব্দ। বোধকরি কৃষ্ণপক্ষের দ্বিতীয়ার চাঁদ আকাশে। যারা প্রযুক্তিমুক্ত কোন জায়গায় মুক্ত আকাশের নিচে আছেন শুধু তারাই জ্যোৎস্না গায়ে মেখে ফাল্গুণের আগমনী টের পাচ্ছেন। মাঘের শেস, শীতের দৌরাত্ন কমে গিয়ে এক হালকা নাতিষিতোষ্ণ আবাহাওয়া বিরাজ করছে।
পেশাগত কাজে কক্সবাজার থেকে দশটার দিকে সহকর্মী Debashis Dutta Roy দাদার সাথে ক্যাম্পে চলমান প্রশিক্ষণ ও সার্ভে পরিদর্শনে টেকনাফ এলাকায় যাই। সংগী দেবাষীষ দা টগবগে তরুণ, সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। আমাদের এগ্রিকালচার সেকটরে তিনি তার অপরিহার্যতা সৃষ্টি করতে সফল হয়েছে। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরীতে নিদর্শনযোগ্য সাফল্যের অধিকারি ‘ব্র্যাক' এর ‘ইয়াং প্রফেশনাল' নামক বিশেষ কর্মসূচীর দ্র্শ্যমান উদাহরণ এই মানুষটি বেশ প্রাণবন্ত ও উদ্যমীও বটে। সফরসংগী বা সহকর্মী হিসেবে সর্বপোরি একজন মানুষ হিসেবে নি:সন্দেহে ভাল। বয়সের বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও তার সংগ উপভোগ্য ও কাংখিত।
১৮ বছরের কর্মজীবনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করেছি। কর্মস্থল নিয়ে ভালো-মন্দ দুধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোথাও যাতায়াত ব্যাবস্থা ভালোনা, কোথাও বা পারিপার্শিক পরিবেশ নিয়ে অসুন্তূষ্টি। কিন্তু বর্তমানের কর্মস্থল এক কথায় অনন্য। সহকর্মী Sazzad Hossain ভাইয়ের ভাষায় ‘ পরিবার ছেড়ে যদি কাজের প্রয়োজনে বাইরে যেতেই হয় সেক্ষেত্রে কক্সবাজারই প্রথম পছন্দ' হওয়া উচিৎ । তার কথায় আক্ষরিক অর্থেই যুক্তি আছে। প্রকৃতি তার এ লীলাভূমিকে অকৃতিমভাবে দিয়েছে। আমার বারে বারে মনে হয় এখানকার অধিবাসিরা সত্যিই ভাগ্যবান। মেরিন ড্রাইভ দিয়ে চলার পথে যখন এ এলাকার নৈসর্গিক পরিবেশের কথা বলছি ড্রাইভার মুক্তার ভাই বললেন গতকাল খগড়াছড়িতে তাকে কেঊ একজন তার বাড়ীর ঠিকানা জেনে প্রত্যুত্তরে বলেছেন ‘ স্বর্গ ছেড়ে সেখানে কেন?’ তিনি যথার্থই বলেছেন। ভীষন সুন্দরের কাছাকাছি এলে বুকে একধরনের অব্যক্ত কষ্ট অনুভূত হয়, অন্তত আমার ক্ষেত্রে। সে মানুষ না পরিবেশ যাই হোক। এরকম অসংখ্য অনুভুতির অভিজ্ঞতা আছে আমার। একবার আমার জ্ঞাতি এক বড়ভাইয়ের স্ত্রী সীমা বৌদি নামক এক অতি সুন্দরী নারীর সাথে পরিচিত হবার সময়েও এমন অনুভুতি হয়েছিলো। সেই অনন্য সুন্দরী নারী আবার আমার সহপাঠী, বন্ধু Triza Nath এর বান্ধবী ছিলেন। বৌদিএখন স্ব:র্গত। কিন্তু সেই রেশ আজো আমার মস্তিষ্কে স্পষ্ট। এখানে আসার পর বার কয়েক সেই একই অনুভুতি হয়েছে, পরিবেশে। এ কাজটি করার ক্ষেত্রে অনেকগুলি কষ্ট আছে, কমবেশি অসুন্তুষ্টি রয়েছে। পরিবার ছেড়ে আসার কষ্ট, থাকার জায়গার দুস্প্রাপ্যতা, খাবার কষ্ট, পজিশনের ডীমশোন, ব্যায় বাহুল্যতা, বেতন-ভাতার অংক, ভাষা বুঝতে সমস্যা, নি:সংগতা ইত্যাদি। এমন অনেক অসুন্তূষ্টিকে এক লহমায় অদৃশ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়ে প্রকৃতি তার নিজের দিকে মহোবিষ্ট করে রাখে। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টির মায়াজালে আবিষ্ট আমি, এক জজানা, নির্বাক, নির্লিপ্ততায় ডুবে যাই।
টেকনাফ থেকে ফেরার পথে দেবাশীষ দাকে ‘ এ এলাকার একটি ট্র্যাজিক রোমান্টিক উপাখ্যান ‘মাথিনের কুপ' সম্পর্কে বলি। এই ইতিহাসের অংশ হিসেবে সুরক্ষিত সেই কুপ দেখার উদ্দেশ্যে টেকনাফ থানার সামনে গাড়ী রেখে আমরা থানা বাঊন্ডারিতে প্রবেশ করি। এ উপাখ্যান সম্পর্কে আগেই আমার অস্পষ্ট একটা ধারনা ছিলো আমার। যতটা সম্ভব এটার উপর ভিত্তি করে কোন টিভি নাটক দেখার সুবাদে। আজ কথা প্রসংগে বিষয়টি আসলেই দেবাশীষ দা আগ্রহ প্রকাশ করে দেখার। আমারও সুযোগ হলো শতাব্দী প্রাচীন এক করুণ ইতিহাসের মুখোমুখি হবার।
ঘটনাটি বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের। বর্ণনা মতে ১৯২৩-২৪ সালের সময়।
গল্পের নায়ক ধীরাজ ভট্টাচার্য। উনি তদানীন্তন যশহর মহকুমার মানূষ ছিলেন।
পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব শুরু করলেও পরবর্তিতে নায়ক হিসেবে সিনেমা জগতেই থিতু হয়েছেন। পদবী, পেশা ইত্যাদি বিচারে পারিবারিক আভিজাত্য, স্বচ্ছলতা, শিক্ষিত, সুদর্শন ও কুলীনতার প্রকাশ স্পষ্ট। শিল্পমনা, উদাসীন প্রকৃতি প্রেমিকও বটে। তখনকার টেকনাফ কল্পনা করি কত দূর্গম এবং একই সাথে আরো কত সৌন্দর্যের সমাবেশ ছিল না জানি। এ জনপদে তখন মগ ও রাখাইন গোষ্ঠীর আধিপাত্য ছিলো। দেশের অন্যান্য জায়গার মত এদিকটাতেও পানীয় জলের কষ্ট ছিলো এবং এই এলাকার একমাত্র কুপটির(পাতকুয়া) অবস্থান টেকনাফ থানার মধ্যে থাকায় এলাকার সকল নারীর আগমন ছিলো অবধারিত। বর্ণনা মতে প্রতিদিন প্রায় ৫০/৬০ জন নারীর কলকাকলিতে মুখর থাকত কুয়া'র পাড়, বিশেষ করে সকাল দিকটায়, যখন দলবেধে সুন্দরী মগ ও রাখাইন যুবতীরা পানি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে জড়ো হত।
সদ্য যোগদান করা পুলিশ কর্মকর্তা ধীরাজের কাছেও সময়টি কাংখিত হয়ে উঠেছিলো নিশ্চয়ই, না হলে অদূরে থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য নিত্য দেখার কথা আসবে কেন। দিনের এ সময়টির জন্যে তিনি অপেক্ষায় থাকতেন রীতিমত। এভাবে চলতে চলতেই একদিন তিনি আবিস্কার করলেন ‘মাথিন' কে। মাথিনের সাজ-গোজ, চেহারা অনেকের মধ্যে ধিরাজের কাছে আলাদা হয়ে উঠতে লাগলো যা পরবর্তিতে এইকরুণ উপাখ্যানের জন্ম দেয়।
‘মাথিন' জমিদার নন্দিনি। তখনকার টেকনাফের জমিদার ছিলেন ওয়ানথিন। মাথিন তারই একমাত্র সুন্দরী ললনা, রূপে-গুণে অনন্যা। চলাফেরা, পোশাক-আসাক, সাজ-গোজে অনেকের মধ্যেই তাকে সহজে পৃথক করা যায়। সৌন্দর্য পুজারী ধিরাজের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করবে সেটাই স্বাভাবিক। শিক্ষিত, সুদর্শন পুলিশ কর্মকর্তার অনুসন্ধানী দৃষ্টির জালে একসময় সরল প্রকৃতি কণ্যা মাথিন আটকে পড়ে। শুরু হয় মন দেয়া-নেয়া। হৃদয়ের টানে সমাজ, সংসার, সংস্কার, ধর্ম সব গৌণ হয়ে যায়। এক সময় ভালবাসার অন্তর্নিহিত যে সত্য তার সুগন্ধ ছড়াতে থাকে অবধারিতভাবে। ভালোবাসার জোয়ারে খড়কুটোর মত ভেসে যায় বিরাজমান পর্বতসম প্রতিকুলতা। জমিদার কণ্যা বলে কথা। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় বিয়ের। এক অনিন্দ সুন্দর প্রেমের উপাখ্যান বাক নেয় এক করূণ শোকগাথায়।
বয়ের সিদ্ধান্তের পরপরই ধিরাজের পিতার ডাকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়াটা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তূ মাথিনের কোমল নিস্পাপ মন তাতে সায় দেয়না, সে কিছুতেই ধিরাজের বাড়ি যাওয়াকে মেনে নিতে পারেনা। হয়তবা প্রিয়জনের আসন্ন বিরহ ব্যাথার কষ্ট কল্পনা করে অথবা চিরতরে হারাবার অজানা আশংকায় সে কোনমতেই ধিরাজের বাড়ি যাওয়াটাকে সহজভাবে নিতে পারেনা। অগত্যা ধিরাজকে পালিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। আর এ ফেরাই মাথিনের কাছ থেকে তার অন্তিম ফেরা হয়ে যায়। ঐদিকে মাথিন ধিরাজ বিহনে অন্ন-জল স্পর্শ বন্ধ হয়ে যায়, শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে। অবশেষে সকলের সকল চেস্টাকে বিফল করে মৃত্যুকে আলিংগন করে রচনা করে যায় এক অমর প্রেমগাথার। পরবর্তি জীবনের সফল নায়ক ধিরাজকে চিরদিনের ভিলেন বানিয়ে নিজেকে প্রেমের রাজকণ্যা হিসেবে অধিষ্ঠিত করে যায় তার জীবনের মূল্যে। জয়তু মাথিন, জয় হোক ভালবাসার।
Lovely
ReplyDelete